দেখা

-রশ্মি ভৌমিক

ভাজা-পেঁয়াজ, রসুন আর গরম-মশলার  লোভনীয় সুবাস রান্নাঘর ছাড়িয়ে শোয়ার ঘরে এসে পৌঁছাতে সঞ্জয় সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলো| কালো ব্লাউজ আর প্রিন্টেড লং-স্কার্ট পরা জয়ীতা, কাঠের হাতা নেড়ে মাংসর টুকরোগুলি নন-স্টিক সসপ্যানে, মশলার সঙ্গে ভালো করে কষিয়ে নিচ্ছিলো| তার মেহেন্দি-করা চুলে হালকা খোঁপা করা রয়েছে| এক কাপ গরম জল, এবার ঢেলে দিলো সসপ্যানে|

উৎসুক সঞ্জয় হাঁক দিলো ” কিগো, দুপুরের খাবার কি তৈরী ? “

জয়ীতা হেসে বললো , “আরো দশ মিনিট চাই | “

জয়ীতা ও সঞ্জয়ের এক ছেলে এক মেয়ে| ছেলে তিন বছরের বড় মেয়ের থেকে| দুজনেই এখন কলেজে পড়ছে | গত দু মাস হলো, বাড়িতে এখন শুধু স্বামী আর স্ত্রী |

ডাল-ভাত শেষ করে সবে মাত্র মাংসটা পাতে নিয়েছে সঞ্জয়, এমন সময় ফোন বাজলো|

“ও প্রতুল বলছো ? কি ব্যাপার ?” সঞ্জয় একদম থমকে গেলো| চোখ গুলো বড় বড়, কাঁচাপাকা দাড়িভরা মুখটা আড়ষ্ঠ হয়ে, কোথায় মিলিয়ে গেলো, গালভরা হাসিটা তার | গম্ভীর স্বরে সে বললো ” আচ্ছা, তাহলে বিকেলে দেখা হবে| “

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা রেখে, কিছু একটা চিন্তায় অন্যমনস্ক হয়ে গেলো সঞ্জয়| মাংস-ভাত মেখে, এক গ্রাস মুখে দিলো| কিন্তু খাবার থেকে তার মন সরে গেছে |

জয়ীতা বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো, ” কি হলো? মাংসটা কি ভালো লাগলো না? কিছু বললে না যে? “

সঞ্জয় ওর দিকে তাকিয়ে বললো , ” মাংসটা সত্যি ভালো হয়েছে …..কিন্তু জানো, স্যাচের শরীর খুব খারাপ| প্রতুল বলেছে বিকেলে ওদের বাড়ি যেতে, দরকারি আলোচনা করতে |”

সন্ধ্যেবেলা প্রতুলের বসার ঘরে সঞ্জয় আর জয়ীতা ছাড়াও তিনজন মাঝ-বয়সী দম্পতি উপস্থিত হয়েছিল| প্রতুলের বৌ মালবিকা ট্রেতে চা আর এক প্লেট মারি বিস্কুট এনে রাখলো, টেবিলে | প্রতুল থমথমে মুখে, মাথা নিচু করে বসেছিল| তার মাথার চুল সল্প হয়ে গেছে| তাতে আলোটা পরে চকচক করেছিল|

জয়ীতা জিজ্ঞেস করলো , ” কেমন আছে স্যাচ ?”

নড়ে চড়ে সোজা হয়ে বসে, চশমাটা ঠিক করে, সবার উদ্দেশ্যে প্রতুল বললো, “দেখো, স্যাচের শরীরের অবস্থা খুব খারাপ| আমরা শুধু জানতাম যে দুবছর আগে ওর শিরদাঁড়ার অপারেশন হয়েছিল | কিন্তু আজ জানলাম যে ওর কিডনি ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছিল গত ১০ বছর ধরে| সকালে, ওর বউ রুচির সাথে দেখা হলো, দোকানে| তার অন্যমনস্ক আর বিচললিত আচরণ দেখে জিজ্ঞেস করলাম – তোমরা সবাই ভালো আছো তো? তখনই সব বৃত্তান্ত জানতে পারলাম| রুচি বললো দুদিন আগেই ডাক্তার সব পরীক্ষা করে জানিয়েছে যে আর কোনো চিকিৎসা করা সম্ভব নয়| এখন শুধু হসপিস কেয়ার-এ থাকবে| মানে ওষুধ দিয়ে কেবল যন্ত্রণা কমানো হবে|”

ঘরে একটা দুঃখের ছায়া নেমে এলো| নিঃশব্দে অনেকেরই চোখ ভরে এলো অশ্রুজল|

মালবিকা চোখ মুছে, কাঁপা গলায় বলে উঠলো, ” আমি কিছুই ভাবতে পারছি না| ফোনে রুচি খুব কাঁদছিলো| “

সঞ্জয় বললো, ” আমরা কি কিছুই করতে পারি না স্যাচের জন্য| “

আরেক বন্ধু বললো, “কি করবো বল?”

“সবাই মিলে স্যাচ আর রুচির জন্য একটা ডোনেশন ফান্ড করলে কেমন হয়?” সঞ্জয় প্রস্তাব রাখলো|

মালবিকা বললো, ” বরং ওদের জন্য রোজ রান্না করে নিয়ে যাবো আমরা, এক এক পরিবার| “

সেদিন গাড়ি চালাতে চালাতে জয়ীতার মাথায় হাজার চিন্তা ভিড় করে আসছিলো| রুচি আর স্যাচ-এর সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়েছিল বাংলা এসোসিয়েশন এর দুর্গোৎসবে| ওরা একটা আধুনিক বাংলা গান পরিবেশনা করছিলো, স্টেজএ| রুচির অসাধারণ মিষ্টি গলা শুনে, হল- ভর্তি দর্শক, মন্ত্রমুগ্ধ| স্যাচ, গিটার বাজানো সময়, রুচির দিকে তাকিয়ে, বুঝে নিচ্ছিলো সুর তাল সব ঠিকঠাক আছে কিনা| ভুল করলে যে রুচির কাছে ভীষণ বকা খাবে, সেই ভয় কি তার ছিল না? জয়ীতা ও বাকি বন্ধুরাও, বছর বছর, ওদের ঘরোয়া পয়লা বৈশাখের রিহার্সালতে, যথারীতি, সুর ভুল করে, রুচির কাছে অনেক সময়ই বকা খেয়ে এসেছে | স্যাচ যখন রুচির দিকে তাকাচ্ছিলো না, তখন সে দর্শকদের তার প্রাণখোলা হাসি দিয়ে আমোদিত করছিলো| সেই হাসি একদম সহজ সরল কিন্তু অনেকেরই মন কেড়ে নিয়েছিল, সেদিন|

রুচির মেয়ে, রাই, জয়ীতার মেয়ে নীতার থেকে মাত্র এক বছরের ছোট| ওদের প্রথম আলাপে একে অপরকে খুব ভালো লেগে গেছিলো| আজ ১৪ বছরেও সেই বন্ধুত্ব অটুট আছে| গতকাল নীতা তার মাকে ফোনে জানিয়েছিল যে দু বছর আগে রাই ওকে স্যাচ- এর ক্যান্সারের খবর দিয়েছিলো| কাউকে বলতে মানা করায়, নীতা জয়ীতাকে কিছুই জানাই নি|

দুদিন পরে, বুধবারদিন,গাড়িটা রুচিদের বাড়ির সামনে থামিয়ে জয়ীতা সর্ষে-ইলিশের বাসনটা পেছন থেকে নামিয়ে নিলো| ইলিশ মাছ স্যাচের খুব পছন্দের| সঞ্জয় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়াতে, আজ সন্ধ্যেবেলা জয়ীতা একাই এসেছে, স্যাচের সঙ্গে দেখা করতে|

ডিসেম্বর শীতের সন্ধ্যাতে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে| উপরে তাকাতে, চোখের পাতায়, নাকের উপর ফোটা ফোটা জলের বিন্দু গড়িয়ে পড়লো, আলতো করে স্পর্শ করে| জীবনের আর যেকটা দিন বাকি আছে, সেগুলি প্রাণ-মন দিয়ে উপভোগ করার মৃদু সংকেত বার্তা জয়ীতা শুনতে পেলো|

স্যাচ-এর ভালো নাম সব্যসাচী| IBM এ অনেক বছর ধরে কাজ করেছে সে| ডিরেক্টর পদে, গত বছর তার প্রমোশন হয়েছে| কাজের জাগাতে সবাই ওকে স্যাচ বলেই ডাকতো| ছয়-মাস আগে সপরিবারে ওরা দেশে ঘুরতে গেছিলো| দেশে যাওয়ার পথে রোম আর ভেনিস শহরগুলো ও পরিদর্শন করতে ছাড়েনি| ফেসবুকে এ ওদের বহু আনন্দের মুহূর্তগুলো লাইক করেছে, জয়ীতা| তখন ও আর অন্যান্য বন্ধুরা কেউই কিডনি ক্যান্সারের কথা জানতো না|

সোফার উপরে বসেছিল মাঝ বয়েসী স্যাচ, চোখ-দুটো ক্লান্তিতে ঢোলে পড়েছে| পা দুটো টুলের উপরে রাখা, একটা গরম চাদর দিয়ে ঢাকা দেওয়া|

রুচি বললো, “অক্সিকোডন দেওয়া হয়েছে কারন সারা শরীরে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, এখন|”

জয়ীতা উল্টো দিকের সোফাতে বসে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো, স্যাচ ?”

ওর গলা শুনে, তাকিয়ে মৃদু হাসলো, স্যাচ| এক পলকের জন্য তার চাহনি জয়ীতার মুখের দিকে থেমে থাকলো| তারপর আবার আসতে আসতে চোখ বন্ধ হয়ে গেলো| মৃদু আওয়াজে একটা ভজন চলছিল পাশের ঘরে| স্যাচের পাশে একটা জলের বোতল রাখা, তাতে তুলসী পাতা দেওয়া| স্যাচ মাঝে মাঝে অল্প করে তাতে চুমুক দিচ্ছিল|

রুচি বললো “গতকাল প্রতুল, শ্রীনিবাস ও আরো চার পাঁচজন বন্ধু দেখা করতে এসেছিলো| স্যাচ তো তেমন কোনো কথাই বললো না| সবাইকে চিনতে পারছে না| রাই আজ বিকেলে দাড়ি কামাতে সাহায্য করেছে| এখন বেশ ভালো লাগছে মুখটা| তাই না ?”

জয়ীতা হেসে বললো “হ্যাঁ, বেশ সুপুরুষ লাগছে|”

বিশ মিনিট পর জয়ীতা ভাবলো বাড়ি ফিরে সঞ্জয়কে রাতের খাবার দিতে হবে| উঠে, কাছে গিয়ে রুচি আর স্যাচকে বললো, ” আমি এখন যাই, তোমাদের পাশেই আছি| কিছু লাগলে জানিও কিন্তু| “

স্যাচ অস্ফুট স্বরে কিছু বলে উঠলো| ওর গলা দিয়ে আর পরিষ্কার করে কথা বেরোচ্ছিল না| জয়ীতা ওর কথা না বুঝতে পেরে, বোকার মতো মাথা নেড়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো|

রুচি ডাক দিল, “জয়ীতা তোমাকে বসতে বলছে|”

জয়ীতা ফিরে এসে আবার বসে পড়লো|

“ইলিশ মাছ করে এনেছি| রাতে খেও তুমি| “

রুচি বললো,” খুব শিগগিরি রাতের খাবার দিয়ে দেব ওকে| শোবার আগে ঠিকমতো হজম হওয়ার সুযোগ পাবে| জানো, স্যাচ এখন সব কিছু ভুলে যাচ্ছে| খুবই কষ্ট পাচ্ছে…”

রুচি কথাটা শেষ করতে পারলো না, দুঃখে ওর গলা ধরে এলো|

নিস্তব্ধ পায়ে দুঃখের ছায়া নেমে এলো স্যাচের বসার ঘরে| সোফার পাশে স্যাচের একুস্টিক গিটারটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো| মাসখানেক অব্যবহারে একটা ধুলোর প্রলেপ পড়ে গেছে তার উপর| তারগুলোর মধ্যে মাকড়শার জাল আটকে আছে| আর কখনো স্যাচ এই গিটারটা বাজাবে না|

রুচি টেবিলে স্যাচের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করছিলো|

“তোমরা খেয়ে নাও আমি তাহলে আসি আজ,” এই বলে জয়ীতা সোফা ছেড়ে উঠে পড়লো|

স্যাচ তাকিয়ে ইশারা করলো পাশের চেয়ার এ বসতে| এর পর আরো কিছু বললো অস্ফুট স্বরে কিন্তু জয়ীতা বুঝতে পারলো না|

রুচি বুঝিয়ে বললো, ” স্যাচ বলছে তুমি রাতের খাবার খেয়ে যাও|”

স্যাচের শরীরের যে অবস্থা তাতে জয়ীতা তার অনুরোধে না করতে পারলো না|

“আচ্ছা, কিন্তু খুব অল্প দিয়ো| রুচি, তুমিও বসে খাও আমাদের সঙ্গে|”

“না জয়ীতা, আমি স্যাচকে বিছানায়ে শুয়ে দিয়ে তারপর খাবো| “

রুচি ঝোল-ভাতটা মেখে দিলো, যাতে খেতে সুবিধা হয়| ভাত-মাখা চামচ দিয়ে তুলতে হাত কাঁপছিলো স্যাচের| এতটুকু পরিশ্রমে হাপিয়ে পড়ছিলো সে| মধ্যে মধ্যে ওর চোখ জুড়িয়ে ক্লান্তি নেমে আসছিলো| কিন্তু এই যুদ্ধে সে পরাজিত হতে রাজি ছিলনা | একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে আবার চেষ্টা করে আরেক চামচ মুখে দিলো| সামনা-সামনি বসে জয়ীতা খুব ছোট্ট গ্রাস করে আস্তে আস্তে খাচ্ছিলো|

খাওয়া শেষ করে বাসন ধুয়ে, জয়ীতা হেসে বললো, “স্যাচ, অনেক ধ্যন্যবাদ| খাবারটা খুব মজার ছিল| এখন আমাকে যেতে হবে| আমি আবার এসে দেখা করে যাবো, কেমন?”

স্যাচ ওর দিকে তাকিয়ে কি বলতে গিয়েও আর বললো না|

রাত সাড়ে আটটা বেজে গেছে| রাতের ঠান্ডাতে, বৃষ্টি এখন বরফ হয়ে পড়ছে| তুলোর রূপ নিয়ে ভিড় করে গাড়ির সামনের কাঁচটা ঢেকে দিচ্ছে| ওয়াইপারটা চালিয়ে দেওয়াতে কাঁচটা বেশ খানিকটা পরিষ্কার হয়ে, সামনের রাস্তা দেখা যেতে লাগলো| গাড়ি চালাতে চালাতে জয়ীতা, বুকের ভেতরে একটা চাপা ব্যথা অনুভব করছিলো|

IBM এর ক্যাফেটেরিয়াতে অনেক দিন স্যাচের সঙ্গে বসে লাঞ্চ খেতে খেতে কত গল্প করতো ওরা| কোনোদিন বাড়ি থেকে টিফিন বাক্স নিয়ে আসতো| আর কোনো কোনো দিন ক্যাফেটেরিয়ার ষ্টল গুলো ঘুরে ঘুরে সুস্বাদু খাবার নির্বাচন করে নিতো ওরা|

একদিন সামনা-সামনি বসে আচমকা জয়ীতার হাতের উপর নিজের হাত রেখে স্যাচ বললো, “জানো আজ কি হয়েছে?”

জয়ীতা স্যাচের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সরল চাহনির পিছনে একটা দুষ্টুমি লুকিয়ে আছে| নাকি সেটা ওরই মনের ভুল? সঠিক বুঝতে পারলো না সে| আসতে আসতে জয়ীতা হাতটা সরিয়ে নিজের দিকে নিয়ে এলো| স্যাচ অফিসের সমস্যার কথা বলতে বলতে সামনের খাবারে মন দিলো|

সেই সব দিনগুলো আজ কত দূরে, জয়ীতার হাতের নাগালের বাইরে|

জয়ীতার মনে হলো, “যদি ওই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে Ericsson এ চাকরি শুরু না করতাম তাহলে কি আমাদের বন্ধুত্ব আরো ঘনিষ্ট হত?”

এই সব ভাবতে ভাবতে জয়ীতার গাড়িটা বড় রাস্তায় এসে পড়লো| বাঁ দিকে বাঁক নিতে গিয়ে, হঠাৎ চোখে জোরালো আলো এসে পড়াতে জয়ীতা চমকে উঠলো| আর সেই সঙ্গে, গাড়িটা বরফে পিছলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দ্রুত গতিতে রাস্তার পাশে একটা খাদে গিয়ে পড়লো|

জয়ীতার মাথাটা স্টিয়ারিং এর উপর নেতিয়ে পড়ে আছে| পাশে রাখা মোবাইল এ নোটিফিকেশন এসেছে রুচির থেকে, হোয়াটস্যাপে, “স্যাচ, আমাদের ছেড়ে চলে গেছে| “